জীবন ঘিরে আল্লাহর লীলা খেলা ?

 

জীবন ঘিরে আল্লাহর লীলা খেলা ?

জীবনে এক একটা মুহূর্ত আসে, যখন ভীষণ অভিমান হয়৷ আর প্রতিটা অভিমান ভরা মুহূর্তেই আমরা কিছু একটা আঁকড়ে ধরে আবারও বেঁচে থাকার প্রেরণা পেতে চাই।


মনে করে দেখুন তো, আপনার জীবনের প্রথম অভিমানের মুহূর্তটা কখন ছিল? হয়তো একেবারে ছোটোবেলায়৷ বা কারো জন্য কৈশোরে। কৈশোরের খুব আবেগী কিছু সময় আছে, তখন কেউ ন্যায্য কারণে বকা দিলেও সহ্য হয় না, ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যাই৷ নিজের বাবা মায়ের কোনো স্বাভাবিক শাসনে বা কথায় বুকে রাজ্যের কষ্ট ভর করে। এরপর একটা সময় আসে, যখন জীবনে নতুন আলোর আভাস দেখা যায়। তখন পৃথিবীর সবকিছুই রঙিন। অচেনা কারো স্বপ্নে কত রাত নির্ঘুম চোখে স্বপ্ন দেখে কাটিয়ে দেয় সে বয়সের ছেলেমেয়েরা।


প্রিয় বাবা-মায়ের ঘর ছেড়ে হাসিমুখেই আরেকজনের ঘর করার জন্য মনে মনে অস্থির আর উতলা হয়ে থাকে প্রতিটা মেয়ের মন। ছেলেরাও তো তাই! ঘর পাল্টায় না, কিন্তু সম্পর্কগুলোর চাহিদা আর আকর্ষণ অনেক বদলে যায়। এরপর এক বিশেষ দিনে বহুল আকাঙ্ক্ষিত বিয়েটা হয়ে যায়৷ নতুন সংসার, নতুন স্বপ্ন। কিন্তু অভিমান যে আমাদের পিছু ছাড়ে না। জীবনের নানা মোড়ে, দেখা-অদেখা কত অলিগলিতে আঘাত পেয়ে পেয়ে মনটা আবারও অভিমানে ভরে ওঠে। এতদিন স্বপ্নে যার ওপর পুরোপুরি আস্থা করে সব অভিমানকে ভুলে যেতে চেয়েছিলেন, আপনি দেখবেন হঠাৎ করেই সেই মানুষটিই আপনাকে বিশাল আঘাত করে ফেললো। একেবারে নীরবে, নিভৃতে, অবলীলায়। আর তখন আবারও আপনার কাছে নিজেকে ভরশূন্য মনে হবে। পৃথিবীর অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে যেতে আপনি আরেকটিবারের জন্য খুব করে চাইবেন একটা কিছু আঁকড়ে ধরতে, কোনো খড়কুটো, কিছু একটা অন্তত, যাকে জাপটে ধরে বেঁচে থাকা যায়!


মৃত্যুপথযাত্রী যদি কোনো শেষ সম্বল খুঁজে পায়, তাকে এত জোরে চেপে ধরে যে মনে হয় যেন জান বেরিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত তাকে কোনোভাবেই ছাড়বে না। এই শেষ ভরসাকে আশ্রয় করে চলা মানুষটা একসময় খড়কুটোর উপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। মা-বাবাকে হারিয়ে, প্রিয়জনের থেকে আঘাত পেয়ে পেয়ে শেষমেশ সে হয়তো তার সন্তানকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকার দূরাশা করে।


অথচ জীবনের চিরন্তন বাস্তবতা, স্নেহের গতি সবসময়ই নিম্নগামী, আর তাই সন্তানকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার যে স্বপ্নটা নিয়ে সেদিন থেকে সে পথ চলতে শুরু করে, সে পথ কখোনোই মসৃণ হয় না, হওয়া সম্ভব না। সন্তান বড় হতে হতে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী দূরত্ব বাড়ে, সন্তানদের ব্যস্ততা বাড়ে আর তারটা কমে। এই হ্রাসবৃদ্ধির অন্তরালে একটা ভয়াবহ একাকিত্বের জালে মানুষটা আটক পড়ে যায়। তার এই একাকিত্ব পাবার কথাই ছিল। যে বারবার তার আপনজনদের থেকেই আঘাত পেয়েছে, সে কীভাবে একই ভুল আবার করতে পারে, কীভাবে আবারও আরেকটি মনুষ্যজীবকেই নিজের পরিপূর্ণ আশ্রয় মনে করতে পারে?


মানুষের হৃদয়ের এ এক ভয়াবহ রোগ! শরীরের রোগ দেখা যায়, কিন্তু মনের রোগ দেখা যায় না। তাই কেউ বোঝে না কার ভেতর কত অভিমান, কত একাকিত্ব জড়ো হয়ে আছে। কেউ বোঝে না নিজেকে মানুষ অন্যের হাতে বন্দি করে কতটা কষ্টে ফেলে দিয়েছে। কেউ জানেনা প্রাণ খুলে হাসতে থাকা মানুষটির বুকে কত অজস্র ক্ষোভ। মনে মনে তার নিজের ওপরই ঘৃণা ধরে গেছে। সমস্ত পৃথিবীর জন্য একরাশ অভিমান নিয়ে সে চাইলে এখনই হাসতে হাসতে মরে যেতে পারে।


কিন্তু এই সমস্ত দুঃখ-কষ্ট, অভিমান, একাকিত্ব, অভিযোগ দূর হয়ে যায়, যার অন্তর আল্লাহর সাথে বাধা। আল্লাহকে শেষ-আশ্রয় হিসেবে দেখা বান্দা তো জানে, তার জীবনে বাকিদের অবস্থান কতখানি, তার চাইতে বেশি সে কারো কাছে আশা করে না। বাবা-মা, প্রেম-ভালোবাসা, সন্তান-সন্ততি কেউই আর তার জীবনের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু নয়, তাই তাদের আঘাতে তার আর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে না। তার কাছে জীবনের সকল কষ্ট সহজ। আসলে সহজ না কিছুই। মোটিভেশনাল স্পীচ আর কবিরাজ বাবার টোটকার মতো ম্যাজিক সলুশন বলে আসলে জীবনে কিছু নেই। জীবন মানেই কঠিন, ভীষণ কঠিন। মনের মধ্যে ফাঁকা-ফাঁকা বোধটা তাকেও প্রায়ই চেপে ধরে খুবলে খেতে চায়। কিন্তু সে তো জানে, আল্লাহ আছে। সে তো জানে, এ জীবনের পর আরেকটা জীবন আছে। শুধু এটুকুই তো শেষ হয়। তাই সব না-পাওয়াগুলো সে পাবার আশায় অপেক্ষা করে। সব কষ্টগুলো একদিন ভুলে যাবার অপেক্ষা করে। সব হারিয়ে ফেলার পরেও জান্নাতে নিজেকে আবিষ্কার করার অপেক্ষা করে। তারও অভিমান হয়। কিন্তু অভিমান তাকে টলাতে পারেনা। তার অভিমানকে দয়ায়-মায়ায় ঘিরে রাখে রবের অস্তিত্ব। যার রহমতে তার অভিমানের বরফ গলে হৃদয় শান্ত হয়ে যায়। নিশ্চয়ই আল্লাহকে রব হিসেবে পেয়ে আমরা সন্তুষ্ট।

© আনিকা তুবা